कुल पेज दृश्य

गुरुवार, 29 सितंबर 2016

শিক্ষাই সমাধান

১.
শিক্ষা কি ? 
'যাবৎ বাঁচি তাবৎ শিখি' -ঠাকুরের এই যে কথা,সেটা আমাদের জীবনে সব সময় মনে রাখা প্রয়োজন। শিক্ষা কি ? কতকগুলি ভাবকে চরিত্রগত করা। আমাদের মধ্যে যে সম্পূর্ণতা আছে তাকে প্রকাশ করা। এর নাম শিক্ষা। 
আমরা স্বামীজীর কাছে শুনেছি, আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে সংযতভাবে সংহতভাবে প্রকাশ করা- এমনভাবে, তা যাতে কার্যকর হয়-এটা শেখার নাম শিক্ষা। শিক্ষা মানে উপযুক্ত চরিত্রের অধিকারী হওয়া। শিক্ষা তাকেই বলে, স্বামীজী বলছেন, যাতে আমাদের চরিত্র গঠিত হয়, যাতে আমরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারি, যাতে আমরা উপযুক্ত মানুষ হয় আমাদের কর্তব্যবোধ সম্বন্ধে সচেতন হতে পারি, যাতে আমরা আমাদের কর্তব্য যথাযথ ভাবে পালন করতে পারি। এরকম উপযুক্ত হয় ওঠার নামই হচ্ছে শিক্ষা। 
শিক্ষা মানে কতকগুলো তত্ত্ব আর কতকগুলো তথ্য কোণ রকমে মাথার ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া, আর সেগুলো হজম হলো না, সারা জীবন জমা হয় থেকে গণ্ডগোল সৃষ্টি করলো মাথার মধ্যে -তাকে শিক্ষা বলে না, স্বামীজী বলছেন। স্বামীজী বলছেন বলেই শুধু নয়। এ সমস্ত কথাগুলো আমরা যদি শান্ত হয় চিন্তা করি তাহলে আমরাও বুঝতে পারবো। সত্যি তো. একে কি শিক্ষা বলে ? শিক্ষা মানে কি স্কুলে কলেজে যাওয়া ? শিক্ষা মানে কি শুধু কতকগুলো বিভিন্ন বিষয়ের তত্ত্ব মুখস্থ করা ? তাকে তো শিক্ষা বলে না। কতকগুলো মুখস্থ করলাম আর গিয়ে পরীক্ষার হলে উত্তরের পাতায় সেগুলো সব লিখে দিলাম -একে কি শিক্ষা বলে ? 
তা দিয়ে আমরা কতকগুলো সার্টিফিকেট পেলাম। সেই সার্টিফিকেটেগুলোর বাজার দর আছে। সেইগুলো বাজারে দেখিয়ে চাকরি পেলাম বা অন্য কিছু করলাম তা ভাঙিয়ে। একে শিক্ষা বলে না। শিক্ষা বলে, আগে যেগুলো বলা হলো সেগুলোকে, যার দ্বারা আমাদের ভেতরের শক্তি কে কাজে লাগাতে পারি উপযুক্তভাবে। উপযুক্তভাবে হলো কি না ? -কি করে বুঝবো ? না, যাতে আমাদের ব্যক্তিগত কল্যাণ হবে, মঙ্গল হবে, ভালো হবে। আমাদের জীবনটা সুন্দর হবে। অসহনীয় হয় ওঠবে না।  
২.
শিক্ষা ও সমাজ 
আমরা নানান শিক্ষা পদ্ধতির পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। নিজেদের শিক্ষিত বলে মনে করছি। কিন্তু আমাদের জীবন কি অনেক সময়ই দুর্বিষহ হয় ওঠছে না ? এমন মনোভাব, এমন চিন্তা, এমন কাজ, পরিবেশ কি আমরা নিজেরাই সৃষ্টি করছি না, যেটা খুব ভালো লাগছে না? আজকে যে সমাজে আমরা রয়েছি, সেখানে যে পরিস্থিতি আমরা দেখছি, তার জন্যে কে দায়ী ? 
আমরাই তো করছি। যে পরিস্থিতি, যে সামাজিক আবহাওয়া আমাদের অনেক সময় অসহ্য লাগে, সেটা তো আমরাই সৃষ্টি করেছি। 
আমাদের শিক্ষা আমরা যেটা নিয়েছি , পেয়েছি সেটার ফলে এমন চিন্তা করছি এবং সেই চিন্তা এমন কাজে রূপ নিচ্ছে যাতে এই রকম পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের পরস্পরের মধ্যে ভাবের এবং অন্যান্য বিষয়ের আদান-প্রদান কি রকম হচ্ছে ? বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে আদান-প্রদান ভাব বিনিময় এবং অন্যান্য জিনিসের বিনিময়ের মধ্যে যেমন একটা সম্পর্ক আমাদের গড়ে ওঠছে যে পরস্পর পরস্পর কে অবিশ্বাস করছি, সন্দেহ করছি । চালাকি বা বুদ্ধি দিয়ে অন্যকে বঞ্চিত করে, অন্যকে ঠকিয়ে প্রত্যেকেই আমরা চেষ্টা করছি, আমি কি করে বেশি লাভবান হতে পারি। এইতো হচ্ছে আমাদের শিক্ষার ফল। একে কি শিক্ষা বলে ? এটা শিক্ষা নিশ্চয় নয়। 
শিক্ষা ঠিক মতন পেলে আমরা আমাদের ব্যক্তিস্বার্থ ততখানি দেখব যতখানি ব্যবহার করলে আমার কল্যাণ হয় এবং সমাজে আমার এবং অন্যান্য ব্যক্তিদের মধ্যে যে আদান-প্রদান সেটা যাতে উভয় পক্ষেরই লাভজনক হয়। পরস্পরের সহায়তা বা কল্যাণ -এটাই লক্ষ্য হবে। অন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কেও আজ অন্তত  এই আদর্শের ভিত্তিতে গড়া হচ্ছে বলা হয়। স্বার্থের দ্বারা প্রনোদিত হয় আমরা কখনই সমাজের যথার্থ কল্যাণ করতে পারি না। সেজন্যে যদি সকলের স্বার্থ আমরা দেখতে চাই, রক্ষা করতে চাই, তাহলে নিজেকে নিঃস্বার্থ হতে হবে। স্বার্থপরতা কমাতে হবে। এবং এই স্বার্থপরতা কমানোটাই সবচেয়ে বড় শেখার জিনিস। যে শিক্ষায় আমাদের নিঃস্বার্থ করে না তা শিক্ষাই নয়। 
কাজেই এটা শিখতে হবে। 
৩.
শিক্ষা ও নৈতিকতা 
আমরা যদি নৈতিক হতে চাই, নীতিকে আমরা যদি কোন মর্যাদা দিতে চাই, তাহলে আমাদের নীতিপরায়ণ হতে হবে। শিক্ষার সেটা দিতে পারা চাই। নীতিটা কি ? নীতি কি নিয়ে ? এ বিষয়ে অনেক বিতর্ক আছে, অনেক মতান্তর আছে। এমন কি Ethics, নীতি-বিজ্ঞান, তাতেও বলা হয় যে, Absolute Morality (অনপেক্ষ নীতি) বলে কিছু নেই। 'Moral' (যা থেকে morality) শব্দটাই এসেছে ল্যাটিন 'mores' শব্দ থেকে; Mores মানে Customs, প্রথা, যেটা প্রচলন আছে।তাহলে প্রচলন যেটা আছে, যা প্রচলিত ব্যাপার সেটা হলেই moral হলো ? এই চলে আসছে। Ethics কথাটি গ্রীক শব্দ 'Ethos' থেকে এসেছে। Ethics মানে character বা চরিত্র বা আচরণ বিধি। আরও অনেক সমাজ দর্শনের তত্বে অনেক জায়গায় প্রায় সর্বজনস্বীকৃত ভাবে এই বলা হয়। কারণ, mores বা customs, প্রচলিত ব্যবস্থা বা প্রচলিত 'Behavior Standards', পারস্পরিক সম্পর্কের মোটামুটি প্রচলিত ধারা সব দেশে সমান নয়, সব কালে সমান নয়। দু' হাজার বছর আগে যা প্রচলন ছিল, যে সমস্ত রীতি-নীতিগুলো ছিল সেগুলি আজকে চলে না, যেটা এদেশে চলে সেটা অন্য দেশে চলে না, ইত্যাদি। কাজেই আমরা ধরে নিয়েছি, নীতি সব দেশে এক রকম হবে না। যেটাকে আমরা moral বা নীতি সমর্থিত বলে আমাদের দেশে মনে করি, সেটাকে হয়ত আর এক দেশ নীতিহীনতা বলে মনে করতে পারে। যেটা আমাদের দেশে নীতিবিগর্হিত বলে মনে করি, সেটা হয়ত আর এক দেশে অনৈতিক নয়। কাজেই এর কোন সাধারণ মান থাকতে পারে না।
এই বললে কিন্তু কি দাঁড়ায় শেষ অবধি ? না, নীতির তেমন কোন মানে নেই; মোটামুটি ব্যবহারের ধারা মেনে চললেই যথেষ্ট। 
তাহলে কোন ব্যবহারের ধারাটা মেনে চলা হবে ? না, দেশে 'যখন যেমন তখন তেমন' হলেই হল। 
কিন্তু ' যেখন যেমন তখন তেমন' -টা কি নীতি হতে পারে ? পারে না। নীতির কোন সংজ্ঞা তাই খুঁজে পাওয়া বড় শক্ত। 
৪.
নীতির সংজ্ঞা 
কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ নীতির একটা অর্থ দিয়েছেন, একটা সর্বজনীন সংজ্ঞা দিয়েছেন। নীতি জিনিস তাকেই বলা হবে যেটা নিঃস্বার্থ। আর যেটার মধ্যে স্বার্থই সব, সেটাই হচ্ছে নীতিহীনতা। 
এই সংজ্ঞাটিকে যদি একটু পরীক্ষা করে দেখি, আমরা দেখবো যে, এটা বহুকাল আগেও সত্য ছিল, আজও সত্য আছে, ভবিষ্যতেও সত্য থাকতেই হবে। ইটা এদেশেও সত্য, বিদেশেও সত্য, সব দেশে সত্য হতেই হবে। সমস্ত দেশে সকল কালে সমস্ত সমাজের মধ্যে ইটা ব্যবহার হতে পারে। এর কোন পরিবর্তন হবে না। এটাই হচ্ছে সর্বজনীন নীতির মান। যেটা স্বার্থপ্রণোদিত সেটা নৈতিক নয়।যেটা স্বার্থহীন বা পরার্থের দিকে নজর রেখে করা হয়, সেটাই হচ্ছে নৈতিক। এই জিনিসটা যে শিক্ষা আমাদের দেবে না, তা কি শিক্ষা হতে পারে ? 
কারন, যে শিক্ষা আমাদের নীতিপরায়ণ করবে না, নীতি বিষয়ে আমাদের দৃঢ় করবে না, সেটা যথার্থ শিক্ষা কখনো হতে পারে ? যে শিক্ষা তা না পারে সেটা কি শিক্ষা হল ? তা শিক্ষাই হল না। কারন, শিক্ষা হবে ভেতরে অনুপ্রবিষ্ট একটা চালক শক্তি। শিক্ষার কাজ ত' তাই, না কি ? শিক্ষা আমাদের সকল চলা-ফেরা, বলা, ব্যবহার -সব কিছুকে একটা বিশেষ দিকে গতি দেবে। একটা দিক ঠিক করে দেবে। কোন দিকে যাব সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। 
যে কোন দিকে যাওয়া যায়, যে কোন করা যায় কি ভাবা যায়। প্রতি মুহূর্তে মানুষের জীবনের দৈনন্দিন, ব্যক্তিগত, সাংসারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক সমস্ত চিন্তা, বাক্য এবং কর্মকে শিক্ষা বিশেষ দিকে চালিত করবে, তাকে নির্ধারণ করতে সাহায্য করবে। যে জিনিসটা তা করতে পারে তাকেই তো যথার্থ শিক্ষা বলে। 
৫.
নৈতিকতার সামাজিক প্রভাব 
সেই শিক্ষা আমাদের লাভ করার চেষ্টা করতে হবে যা আমাদের নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে শেখাবে, আমাদের সমস্ত শক্তি কে ঠিকভাবে ব্যবহার করতে শেখাবে। ঠিকভাবে ব্যবহার করতে শিখাবে মানে ? ঠিক-বেঠিক কি তা বুঝতেও শিখাবে ! ঠিক কোনটা কি করে বুঝবো ? যেটা নীতির দ্বারা সমর্থিত তাকেই ঠিক বলি, যেটা নীতিবিগর্হিত তাকেই বেঠিক বলি। 
ঠিক মানে হচ্ছে, যেটা নীতির দিক থেকে ঠিক। তাহলে কোনটা নীতির দিক থেকে ঠিক না, যেটাতে স্বার্থ জড়িত নেই! কেননা স্বার্থ জড়িত থাকলে আমি দেশ থেকে আলাদা হয়ে যাব। আমি সমাজে বাস করছি, সকল মানুষ কে নিয়ে আমাকে থাকতেই হবে। কিন্তু সেখানে যদি আমি স্বার্থ দেখতে থাকি, আর প্রত্যেকেই যদি তার স্বার্থ দেখতে যায়, তাহলে ক্রমাগত পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলবে, পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলবে। কে কাকে হারিয়ে দিতে পারে, কে কাকে বঞ্চিত করতে পারে, কে কাকে শোষণ করতে পারে-এই ভাবগুলোই প্রাধান্য পাবে সকলের মনের মধ্যে এবং যদি ক্রমাগত আমরা এই ব্যবহারকে প্রশ্রয় দিতে থাকি,তাহলে সেগুলো আমাদের স্বভাবে পরিণত হবে। এবং স্বভাবে পরিণত হলে আমরা ওই রকম আরও বেশি করে করতে থাকব,ফলে সমাজ-জীবন বিপন্ন হবে।
আজকে সমাজ-জীবন সেই জন্যেই বিপন্ন হয়েছে, যেহেতু আমরা উপযুক্ত শিক্ষা নেবার চেষ্টা করিনি। সেই উপযুক্ত শিক্ষা নেবার প্রয়োজনীয়তা যদি আমরা বুঝি তাহলে একটা মস্ত লাভ হবে। আমাদের বুঝতে হবে, আমরা যেন উপযুক্ত ভাবে শিক্ষিত হই। 
৬.
শিক্ষা ও চরিত্র 
উপযুক্তভাবে শিক্ষিত হওয়া তাহলে অনেক দিক থেকে দেখা যায়। আমরা ঠিক নীতির কাজ করতে পারছি কি না, আমরা কতগুলো ভাব ঠিক আয়ত্ত করতে পারছি কি না, সেগুলো আমাদের নিজস্ব করে ফেলতে পারছি কি না। আমরা আমাদের যে শক্তি আছে, নিজেদের শক্তি,দেহের শক্তি,মনের শক্তি, ভেতরের শক্তি -সেইগুলোকে  উপযুক্ত ভাবে কাজে লাগাবার বুদ্ধিটা বিদ্যাটা অর্জন করছি কি না,এগুলো বোঝা দরকার। 
আমাদের মধ্যে যে পূর্নতা আছে, যে সম্ভাবনা আছে সুপ্ত, তাকে প্রকাশ করতে পারছি কি না সেটা দেখতে হবে। এটাই হচ্ছে উপযুক্ত শিক্ষা। এবং এই শিক্ষা লাভ করলে যেটা হয়, আমাদের যে পরিবর্তন হয়, আমাদের যে নতুন আকৃতি হয় (আকৃতি মানে দেহের আকৃতি নয়), আমাদের মনের যে নতুন গঠন হয়, সেই গঠন আমাদের সমস্ত চিন্তা আর কাজকে চালিত করবে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সেটার নামই হল কিন্তু চরিত্রে। উপযুক্ত শিক্ষাই আমাদের চরিত্র গঠনে সাহায্য করে।         
 ৭.
শিক্ষার প্রথম কথা মন
এর পেছনে সেই জন্য থাকবে সব থেকে প্রাধান্য যে জিনিসটির, সেটি হল ঠিক চিন্তা। যথার্থভাবে চিন্তা না করতে পারলে কিন্তু এর কোনটা হবে না। সেজন্য মনটার দিকে নজর দিতে হবে খুব ভাল করে। মনটাকে সংযত না করতে পারলে, আমরা আমাদের চিন্তাকে ইচ্ছে মত খাতে প্রবাহিত করতে পারব না এবং চিন্তা যদি আমাদের ইচ্ছানুরূপ খাতে প্রবাহিত না হয়,তাহলে আমাদের সমস্ত কাজ ঠিক দিকে যাবে না, নীতির দিকে যাবে না। নীতির দিকে যাবে না মানে স্বার্থের দিকে যাবে। পরার্থের দিকে যাবে না মানে সমাজ-জীবনকে বিপন্ন করবে। 
সেজন্য ঠিক চিন্তার ওপরে খুব গুরুত্ব দিতে হবে। এবং সেটার জন্যে নিজেদের শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা করতে হবে। এই রকম করলে, এই নীতিবোধ নিয়ে জাগতে থাকলে, এই রকম শিক্ষা পেলে এই রকম চরিত্রে ধীরে ধীরে গঠিত হতে থাকলে, তখন আমরা কোনটা আমাদের কর্তব্য সেটা ঠিক বুঝতে পারবো। 
৮.
অধিকার ও কর্তব্য 
আমরা অধিকারের জন্য অনেক সময়ই চিৎকার করে থাকি। কিন্তু কর্তব্যের সম্বন্ধে কখনই চিৎকার করি না। কিন্তু কর্তব্য সম্বন্ধে যদি আমরা সচেতন না হই, অধিকার কখন পেতেই পারি না। এটা বোঝা উচিত। আমরা ঠিক ঠিক কর্তব্য করলে তবেই আমাদের ন্যায্য অধিকার ঠিক ঠিক লাভ করতে পারবো। তা না হলে কখনই পারব না, শুধু যদি আমরা আমাদের অধিকারের কথাই বলে যাই। অধিকার কি থেকে জন্মায় ? অধিকার আমাদের কর্তব্য থেকেই জন্মায়। আমরা কর্তব্য সম্পাদন না করলে আমাদের অধিকারই থাকবে না। কিসের ওপর অধিকার বর্তাবে ? 
আমরা কর্তব্য পালন করলে যে সমস্ত জিনিস উৎপন্ন হবে, তৈরি হবে, সেগুলো ব্যবহারিক। 
বাইরের যেমন দ্রব্য সামগ্রী ইত্যাদি আছে তেমন মনোজগতেরও আছে । মনোজগতেরও যে কর্তব্য আমাদের আছে, norms, যে নীতি, যে সৎ চিন্তা, যে সৎ উপায়, যে সকলের চিন্তা, সকলের কল্যাণের চিন্তা, সকলের ভাল হওয়ার পরিপেক্ষিতে যে চিন্তা, সেই চিন্তা করলে মূল্যবোধ (Values) -এর সৃষ্টি হয়, যার সামাজিক মূল্য, মানবিক মূল্য আছে।  
৯.
কর্তব্য ও মূল্যবোধ 
মানবিক বা সামাজিক মূল্যবোধ মানুষের মন থেকে আসে। মানুষের মন থেকে সামাজিক মূল্য সমাজ প্রতিষ্ঠা পেতে পারে আমাদের কর্তব্যের বোধ থেকে। আমাদের প্রথম কর্তব্য অপরের কল্যাণের জন্য চিন্তা করা। অপরের প্রয়োজন, অপরের সুখ, অপরের কোন বিঘ্নের নিবারণ। এগুলো হচ্ছে মস্ত কর্তব্য। এই কর্তব্যগুলো থেকে বিভিন্ন বিষয়ের মূল্যবোধ আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয় এবং এগুলো শিক্ষার বিশেষ প্রয়োজন। 
এগুলো থেকেই আমাদের চরিত্র গড়ে ওঠে । এগুলো থেকেই আমরা সমাজ-সচেতন হই। আমরা সমাজ সচেতন না হলে কার কাছে অধিকার আদায় করব ? আমরা অধিকার আদায় করবো যে সমাজের কাছে থেকে, সে সমাজের যদি মূলধন না থাকে, সে অধিকারটা কোথা থেকে আদায় করব? 
কিন্তু সামাজিক মূলধন শুধু অর্থের দ্বারাই সৃষ্ট হয় না। ভাব-জগতের মূলধন সমাজ-জীবনের জন্য অপরিহার্য! মূল্যবোধের মূলধন যদি সমাজে না থাকে তাহলে অধিকারটা কোথা থেকে আদায় করব ? তবিল নেই টাকা কোথায় পাব ? সমাজে যদি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত না থাকে, যদি সুযোগ-সুবিধে না থাকে, যদি সমাজে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি, পরস্পরের মঙ্গলের জন্য করব্যবোধ না থাকে, তবে আমার অধিকারটা মেটাবে কে ? যে মেটাবে সে তো আমিই ! এই অর্থে অধিকার মেটাবে সমাজ, কিন্তু আমি তো সমাজের অংশ। 
সমাজ অধিকারগুলো দেবে কোথা থেকে ? সমাজ তা পাবে কোথায় ? আমি তো সমাজের অংশ। আমার যেটুকু কর্তব্য তা আমি যদি না করি তো সমাজ কোথা থেকে আমার অধিকারগুলো মেটাবে ? এটা সম্ভব নয়। একটা দুধের পুকুর হবে এরকম প্রস্তাব সকলেই যদি ভাবে, আর সবাই তো দুধ দিচ্ছে আমি একটু জল দিলে কি ক্ষতি হবে, তাহলে কিন্তু সেটা দুধ-পুকুর হয় না, জলের পুকুর হয়। দুধ পুকুর করবার প্রকল্প নিয়ে যদি সকলেই জল ঢালি তাহলে দুধটা সেখান থেকে পাব কি ? পাব না। প্রত্যেকের যেটা কর্তব্য, প্রত্যেকেই সেটা সম্পাদন করতে হবে। তবেই পরে আমাদের কিছু অধিকার জন্মাতে পারে, অর্থাৎ আমি যদি কিছু দিয়ে থাকি তবে প্রয়োজনে আমি কিছু পেতেও পারি। 
সেই অধিকার যে পাব তার জন্যে আমার যে কর্তব্য, পুকুরে একমাত্র দুধ দেওয়ার কথা ছিল, সেটা আমাকে করতে হবে। আমার কর্তব্য না করে কখনই আমি অধিকার আদায় করতে পারি না। কারন, তা হতে পারে না। এ জিনিসটা শেখা আমাদের অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমাদের চরিত্রে মধ্যে এই কর্তব্যবোধ না থাকলে আমাদের চরিত্রই হল না। আমাদের কর্তব্য সমন্ধেও যথেষ্ট সচেতন হতে হবে। আমাদের সমাজ, জাতির প্রতি আমাদের দায়িত্ব আছে সেটা ভুললে চলবে না এবং চরিত্র-গঠন কিন্তু সেই জন্যেই করতে হবে। কারণ, আমাদের সমাজ বা জাতি কাদের নিয়ে ? আমাদের নিয়ে। আমাদের প্রত্যেক কে নিয়েই আমাদের জাতি, আমাদের সমাজ। আমাদের সমাজকে যদি ভাল করা আমাদের লক্ষ্য হয়, আমাদের জাতিকে গড়ে তোলা, বড় করে তোলা যদি আমাদের দায়িত্ব হয়, তাহলে প্রত্যেককে আমাদের নিজেদের ভাল হতে হবে, তৈরী হতে হবে, যথার্থ শিক্ষিত হতে হবে, মানুষের মতন মানুষ হতে হবে, চরিত্রবান হতে হবে। এই সোজা কথাটা বুঝতে হবে। এইটে আমাদের দেশের জন্য করা প্রয়োজন। 
১০.
সমাজের ভাবনা 
সকলকেই এই চিন্তায় ভাবিত হতে হবে। সকলে যদি এই চিন্তা না করে, আর তার যেটুকু কর্তব্য, সে যদি সেটা সম্পাদন না করে তা হলে এটা তো হতে পারে না। কি করে হতে পারে এত বড় জিনিসটা ? কারোর একার চেষ্টায় তো হবে না। (মহামণ্ডলের) লক্ষ্যটা হল, উদ্দেশ্যটা হল দেশের ভাল, জাতির ভাল, সমাজের ভাল-আমাদের জাতির মঙ্গল, কল্যাণ। আমরা অনেকেই ছুটে বেড়িয়ে যেতে চাই দেশের কল্যাণ করতে ! 
কিন্তু ভাবি না, কোথায় যাচ্ছি ? কার কল্যাণ করছি ? কি ভাবে কল্যাণ করছি ? হয়ত নিরন্নকে অন্ন দিচ্ছি, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দিচ্ছি, বন্যায় বা অন্য কিছুতে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের বিভিন্ন রকম সাহায়্য দিচ্ছি, রোগীকে ঔষধ দিচ্ছি,অশিক্ষিতকে কিছু শিক্ষা দেবার চেষ্টা করছি, যে গৃহহীন হয়ে পড়েছে, তাকে বাড়ী তৈরী করে দেবার চেষ্টা করছি। খুব ভাল। কিন্তু এটা হচ্ছে প্রাথমিক। একটু নিচু স্তরের।  
এর থেকে আরও বড় সাহায্যের প্রয়োজন আছে। এর চেয়ে বড় সাহায্য হল মানুষকে ভাব দেওয়া। ভাবে যারা দরিদ্র তাদের ভাবসমৃদ্ধ করে তোলা,মানুষকে সৎ চিন্তায় সমৃদ্ধ করে তোলা। এটা খুব প্রয়োজন। যেমন, যে মানুষ পেটে খেতে পায় না, বুদ্ধি নেই, জ্ঞানের আলো যাদের মধ্যে নেই, তাদের সেগুলো দেওয়া খুব ভাল কাজ। কিন্তু তার চেয়েও বড় কাজ হচ্ছে তাদের সদবুদ্ধি দেওয়া। এবং তারও ওপরে আছে। আমরা ততদূর যাচ্ছি না, সেটা আরও একটু শক্ত। সেটা হচ্ছে আত্মিক দিক থেকে তাদের উন্নত করা। ধর্মবোধে তাদের উন্নত করা। 
১১.
ধর্মবোধ ও আধ্যাত্মিকতা 
(৩H) 
ধর্মবোধটা অবশ্য খানিকটা বুঝতে পারা যায়। ধর্মবোধ মানেই হচ্ছে কর্তব্যবোধ। ধর্মের প্রাথমিক মানে, যেটা বিশেষ প্রয়োজন -সেটা হচ্ছে কর্তব্যপরায়ণতাআমাদের ধর্ম কি ? মানুষের ধর্ম কি? আমাদের কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন হওয়া। এবং সেই ধর্মের উপরের স্তরের যেটা, সেটা হচ্ছে তাদের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি খুলে দেওয়া। তাদের অনুভূতিকে এমন একটা স্তরে নিয়ে যাওয়া যাতে সে সেখানে সমস্ত মানুষের ঐক্য উপলব্ধি করতে পারে। ইটা হচ্ছে আধ্যাত্মিক সম্পদে মানুষ কে সমৃদ্ধ করা। এই দান এই সমাজ-সেবা যদি হয় সেটাই হবে শ্ৰেষ্ঠ সমাজ-সেবা ! তাই পরের স্তরে মানুষ কে ধনাত্মক চিন্তা, গঠনমূলক চিন্তা, উদ্দীপনাময়ী চিন্তা, বিশেষ করে যুবকদের মধ্যে,দেওয়া বিশেষ প্রয়োজন।     
আর তার নীচে হচ্ছে প্রানধারনের জন্যে, বেঁচে থাকার জন্যে আশু প্রয়োজন মেটাবার চেষ্টা। এটাও খুব প্রয়োজন কোন সন্দেহ নেই। কারন একজন মানুষ না বাঁচলে সে যুক্তি, বুদ্ধি, ভাব নিয়ে কি করবে? সে কোথায় আত্মার উন্নতি করবে? আত্মা কে যে সে উন্নত করবে,আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যে উন্নত হবে, তা কি নিয়ে করবে সে ? সে আত্মিক বুদ্ধিটা খুলবে কোথায় ? তার তো একটা আধার চাই, একটা কিছু তো চাই যেখানে সে মানুষটা চেষ্টা করবে। সেটিই হচ্ছে মানুষের দেহ ! কাজেই দেহটাকে বাঁচাতে হবে। সে জন্যেই কথা আছে,  " शरीरमाद्यं खलु धर्मसाधनम् ।।"  ५.३३ ।। [The human body is the foremost means of practicing purushartha' कुमारसम्भवम् - मल्लिनाथः/ কালিদাস কৃত কুমারসম্ভব সর্গ ৫/৩৩यह शरीर पुरुषार्थ करने के लिए सब से महत्त्वपूर्ण आद्य साधन है; इस बात का ध्यान रखते हुए मनुष्य को कभी शरीर की उपेक्षा नहीं करनी चाहिए। ]
কারন এই দেহের মধ্যে দিয়েই আমরা সব কিছু করব। দেহটা আমাদের একটা যন্ত্র। আমরা দেহ-সর্বস্ব নই। যে শিক্ষার মধ্যে থেকে আমরা এই দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করি, সেটাই হচ্ছে যথার্থ শিক্ষা   
অর্থাৎ আমরা কি ? আমাদের কি আছে ? ভাল করে জানতে হবে এবং যেটা আছে তাকে ভাল করে বিশ্লেষণ করতে হবে। তার মূল্য, তার বিভিন্ন অংশের মূল্য, আমাদের ভাল করে বুঝতে হবে। কেন বুঝতে হবে ? না, যে বিভিন্ন অংশ দিয়ে আমরা তৈরী, সেগুলোর যথার্থ মূল্য ও প্রকৃতি 
জানলে তবে আমরা সেগুলোর সদুপযোগ, সৎ ব্যবহার করতে পারব। আমাদের যা আছে তার যদি সৎ ব্যবহার না করি তাহলে তা কাজে লাগল না, ব্যর্থ হল, বিফল হল। কাজেই আমরা কি -সেটা ভাল করে জানতে হবে
আমরা দেখছি, প্রথম দেহ। কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা যদি এই দেহটা জেনেই থেমে যাই, তাহলে কিন্তু আমাদের অন্য সম্পদগুলো অনাহৃৎ (?), অব্যহৃত থেকে গেল। আমাদের দেহের ভেতরে মন আছে, বুদ্ধি আছে, তার ভেতরে আমাদের আত্মা আছে, সেগুলোর সদুপযোগ হল না, সদ্ব্যবহার হল না। সেগুলো ব্যর্থ হল, নষ্ট হল। তা হলে আমাদের যেটা ছিল তার উপযোগিতাটা আমরা পেলাম না, নষ্ট হয়ে গেল।  
কিন্তু এই যে বুদ্ধি বা আমাদের ভাব বা চিন্তার যে জগৎটা তারও কিন্তু আধারটা হল আমাদের দেহ।আর আমাদের যে আত্মা, আমাদের যে আধ্যাত্মিক দৃষ্টির কথা বলা হচ্ছে, সেটার দরকারটা হচ্ছে শুধু,আমাদের ঐক্য বোঝবার জন্যে। আমরা কেন সমাজসেবা করব ? আমরা কেন অন্য লোকের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার চেষ্টা করব ? আমরা কেন চাইব আমাদের দেশের ভাল হোক, মঙ্গল হোক? এই জন্যেই চাইব যে আমরা আলাদা নই। 
এবং একমাত্র এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের প্রতিযোগিতার বুদ্ধি, পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক পথ দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করবার যে নীতিবিগর্হিত মনোভাব,তা থেকে আমাদের বাঁচাতে পারে। কাজেই যদি আমরা নীতির পথে গিয়ে ব্যক্তির এবং দেশের কল্যাণ করতে চাই, তা হলে আমাদের এই আধ্যাত্মিক দৃষ্টির একটু প্রয়োজন আছে। 
মানে এই নয় যে, শুধু তথাকথিত ধর্মগুলো খুব বাড়াতে হবে। অনেক মন্দির, অনেক গির্জা, অনেক মসজিদ থাকলেই এই আধ্যাত্মিক দৃষ্টি মানুষের খুলবে না। সেগুলোর প্রয়োজন অন্য আছে। কিন্তু এই আধ্যাত্মিক দৃষ্টির প্রয়োজন আছে। এই আধ্যাত্মিক দৃষ্টি আমাদের ঐক্যবোধটা জাগায়। এই ঐক্যবোধ, এই সহমর্মিতা এই দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া আসবে না। চাপিয়ে দেওয়া সহানুভূতি বা অপরের জন্য চিন্তা বেশি কার্যকর হয় না, দীর্ঘস্থায়ীও হয় না, শেষ পর্যন্ত স্বার্থের দিকে ঝুঁকে পড়েই। 
১২.
শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতা 
কিন্তু সেই দৃষ্টি যদি আমরা লাভ করি বা পাই তাহলে আমাদের মানুষের মধ্যে যে আন্তর ঐক্য আছে, যে একটা সূত্রে আমরা গ্রথিত পরস্পরের সঙ্গে, সেই সূত্রটাকে আমরা আবিষ্কার করতে পারব। সেইজন্যে ওই দৃষ্টিতে উন্নত হওয়া আমাদের অত্যন্ত প্রয়োজন। এই দৃষ্টিলাভও প্রকৃত শিক্ষার অন্তর্গত! 
এ শিক্ষা যদি আমরা না পাই তা হলে আমাদের শিক্ষা অসম্পূর্ন থেকে গেল। সেজন্যেই যথার্থ ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা আর শিক্ষা খুব ভিন্ন জিনিস নয়। শিক্ষা ব্যাপক অর্থে যেখানে আছে সেখানে অধ্যাত্মিকতাও অন্তর্ভুক্ত। তার নীচে হচ্ছে আমাদের সৎভাব, সৎচিন্তা, সদবুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা। সদবুদ্ধি আর এই আধ্যাত্মিক ঐক্যবোধ কার্যকর হবে কিন্তু মানুষের দেহযন্ত্র দিয়ে। সেই জন্যে সেই দেহ-যন্ত্রটাকে সুন্দর, সবল, কার্যকর রাখার প্রয়োজন আছে। তাকে গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে। 
তাই যখন আমরা চরিত্রগঠনের চেষ্টা করব, তখন সেই চরিত্রগঠনের অঙ্গীভূত হবে আমাদের দেহটাকে সুস্থ সবল রাখা। সুস্থ সবল দেহের মধ্যে একটি সুস্থ সবল মনের অধিকারী আমাদের হতে হবে। সে মন এবং দেহ চালিত হবে আমাদের আধ্যাত্মিক ঐক্যবোধের দ্বারা। এইটে যখন আমরা সমানভাবে করতে পারব তখন আমরা আমাদের শিক্ষিত বলতে পারব, তখন বলতে পারব আমাদের চরিত্র গঠিত হয়েছে, সুগঠিত, সুসংহত চরিত্র আমরা পেয়েছি। তখন আমরা বুঝব আমাদের অধিকার কোথায়, তখন আমরা সকলে সচেতন হব আমাদের কর্তব্য সম্বন্ধে, তখন আমরা আমাদের সমাজ ও জাতির যথার্থ কল্যাণ বুঝতে পারব, এবং সুষম ও সুন্দরভাবে আমাদের দেহ,মন, আধ্যাত্মিক বা আত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি -আমাদের সম্পদ বলতে যা কিছু আছে, সেগুলির সদুপযোগ করতে পারব সার্বিক কল্যাণের জন্য। 
আমাদের নিজস্ব সম্পদ বলতে এইটুকুই আছে -আমাদের দেহ আছে, মন আছে, আমাদের একটা আত্মা আছে ! কিন্তু সেই দেহ, মন আর আত্মার সুষমভাবে আমরা যদি শ্রীবৃদ্ধি না করতে পারি, তাদের মধ্যে যে নিহিত শক্তি আছে, সেগুলোকে যদি উপযুক্তভাবে ফুটিয়ে তুলতে না পারি, সেগুলির সুপ্ত শক্তিকে যদি জাগিয়ে তুলতে না পারি, আমাদের কথায়, চিন্তায় আর কাজে তাদের যদি প্রকাশ উপযুক্তভাবে আমরা সাধিত না করতে পারি, তাহলে আমরা যথার্থ শিক্ষিত হতে পারলাম না। 
আর এ রকম যদি করতে পারি তা হলে আমাদের দেহ, মন আর আত্মার ব্যবহারের দ্বারা আমরা আমাদের সমাজের, জাতির তথা সমগ্র মানব-জাতির কল্যানে আমাদের একমাত্র সম্পদ -আমাদের এই দেহ, মন আত্মা -সমর্পন করতে পারব। আমাদের এই দেহ, মন ও আত্মার সুষম বিকশিত সমাহারকে এ জগতে মানবজাতির সেবায় সম্পূর্ণ উৎসর্গ করতে পারা , সমর্পন করতে পারাটাই হচ্ছে মনুষ্য জীবনের একমাত্র সার্থকতা। মনুষ্য-জীবনের এই সামগ্রিক সার্থকতার পথে আমাদের যা চালিত করে নিয়ে যায়, তাই হচ্ছে আমাদের যথার্থ শিক্ষা। এই শিক্ষাই আমাদের চরিত্র গড়ে তোলে। 
১৩.
চরিত্র কি 
এগুলো মোটামুটি বুঝলাম। কিন্তু কোথায় কাজ শুরু করব ? এবং কিভাবে কাজ করব ? জগতের কল্যাণ, দেশের কল্যাণ, জাতির কল্যাণ, আমাদের চরিত্র গঠন, আমাদের কর্তব্যবোধ, আমাদের অধিকার কোথায় আছে, কেমনভাবে পাওয়া যায়, কর্তব্য না করলে অধিকার পাওয়া যায় না, চরিত্র গঠন করার প্রয়োজন, শিক্ষার প্রয়োজন, শিক্ষা কাকে বলে আমরা না হয় বুঝলাম। কিন্তু কি করে করব ?   
কি করে করব বুঝতে গেলে আমাদের আর একটু ভেতরে যাওয়া প্রয়োজন, চরিত্র কাকে বলে জানা প্রয়োজন। খুব সংক্ষেপে, চরিত্র প্রকাশিত হয় আমাদের চিন্তায়, কথায়,কাজে।যে কোন ব্যক্তির চিন্তা, কথা এবং কাজ দেখে আমরা তার চরিত্র সম্বন্ধে কিছু ধারণা করতে পারি। আমাদের চরিত্র হচ্ছে আমাদের ব্যবহারের সমগ্রতা। এবং ব্যবহার করবার যে বিশেষ ভঙ্গিটি এক একজনের আছে সেটিই হচ্ছে তার ব্যক্তিত্ব বা চরিত্র। 
আমাদের এই চরিত্রের প্রতিফলন হয় আমাদের চিন্তায়, কথায় এবং কাজে। এই চরিত্র গড়ে ওঠে আমাদের অভ্যাসের মধ্যে দিয়ে। কাজেই আমাদের অভ্যাসগুলোকে আমরা যদি ভাল করতে চেষ্টা করি তাহলেই আমাদের ব্যক্তিত্ব এবং চরিত্র ভালভাবে তৈরী হবে। এবং ভাল ব্যক্তিত্ব, ভাল চরিত্রই আমাদের জাতির প্রতি, সমাজের প্রতি কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন করবে। আর আমরা পূরো সার্থকতা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারব। তাহলে হাতে-নাতে কাজ আরম্ভ করতে পারি আমরা আমাদের ভাল অভ্যাস করার মধ্যে দিয়ে।
ভাল অভ্যাস কি করে হয় ? প্রশ্ন হতে পারে, ভাল অভ্যাস হলেই ভাল হবে কেন ? চরিত্র কাকে বলছি আমরা ? বুঝতে পারছি কাকে চরিত্র বলে। চরিত্র অনুসারেই তো আমরা ব্যবহার করি। আমাদের ব্যবহার দেখে আমাদের চরিত্র বোঝা যায়। একজন একটা কোন অবস্থায় যে ভাবে প্রতিক্রিয়া করে তার চিন্তায়, তার কথায়, তার কাজে, তাই দিয়ে লোকটির চরিত্র কেমন তা বুঝতে পারা যায়। 
একটা উদাহরণ। এক জায়গায় একটা মূল্যবান জিনিস রইল, কেউ কোথাও নেই। সেখানে একটি লোক এলে সেই জিনিসটা নিয়ে সে যা করবে সেটা দেখে তার চরিত্র বোঝা যাবে। কেউ চেষ্টা করবে লুকিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে সেটাকে নিজের করে নিতে; কেউ চেষ্টা করবে জিনিসটা যার হারিয়েছে তাকে খুঁজে বার করতে -এই দুরকম পরস্পর বিরোধী একটা একটা কাজ। এক এক জনের ব্যবহার, আচার, আচরণ তার চরিত্রের পরিচয় দেবে। 
আচ্ছা, একজন দুটোর এক এক রকমটা করবে কেন ? একজন সেটা আত্মসাৎ করবার চেষ্টাও করতে পারে আর যে হারিয়েছে তাকে ফিরিয়ে দেবার চেষ্টাও করতে পারে, তার জন্যে নিজের কাজ ফেলে হয়ত সময় নষ্ট করবে। এ রকমটা করবে কেন ? করবে এই জন্যে যে, যেমন স্বভাব বা যেমন অভ্যাস আগে করে রেখেছে সেই অনুসারে তারা উভয়েই কাজ করবে। সেটিই নির্ধারণ করবে কোন ব্যক্তিটি এখন কি রকম করবে না করবে। একজন যেটা নীতি সমর্থিত মনে হবে সেটিই করবে। 
কিন্তু কেন নীতিসমর্থিত জিনিস করবে ? নীতি সমর্থিত জিনিস করবে তখনই যখন সে অভ্যাস করেছে নীতিকে মেনে চলা। নীতিসমর্থিত কাজ করবার অভ্যাস যদি তার না থাকে তা হলে সে সেই মুহূর্তে দুটো জিনিসের দ্বারা তাড়িত হতে পারে, মানসিক দিক থেকে। একটা হতে পারে, তার লোভ তাকে বলতে পারে, "তুমি এটা আত্মসাৎ কর। আত্মসাৎ করার সুযোগ পেয়েছ, এই সুযোগে এটি আত্মসাৎ কর।" লোভ বৃত্তিটি (লস্ট এন্ড লুকর প্রতি) যদি প্রবল থাকে তার মধ্যে তা হলে সে সেরকম করবে।
আর তার যদি অভ্যাস হয়ে থাকে, একজন হারিয়েছে, এটা তার পাওয়া উচিত; পরের কল্যাণ, পরের ভাল করবার যদি তার অভ্যাস থেকে থাকে, আমি সত্য থেকে, নীতি থেকে কখনও বিচলিত হব না -এটা যদি সে অভ্যাস করে রেখে থাকে, তাহলে তখনকার তার বিচার তাকে বলবে যে,
"লোভ একটু উকি দিচ্ছে বটে , ওটায় অভ্যাস নেই, প্রবৃত্তি নেই। আমার প্রবৃত্তি বা অভ্যাস হচ্ছে, নীতি সমর্থিত যা তাই করা। কারন,আমি সঙ্কল্প করে অভ্যাস করেছি যে, নীতিবিগর্হিত কাজ কখনও করব না।"  কাজেই দুরকম অভ্যাসের সম্ভাবনা তার নেই। তার বিচার তাকে নীতির দিকে নিয়ে যাবে এবং সে তার জিনিসটা তাকে ফেরৎ দেবার চেষ্টা করবে। 
তা হলে দেখছি, আমাদের যে চরিত্রের প্রতিফলন আমাদের আচরণের মধ্যে, সেটা নির্ধারিত হচ্ছে আমাদের অভ্যাসের দ্বারা। 
১৪.
 সচেষ্ট অভ্যাস 
অভ্যাস কি করে হয় ? বার বার একই কর্ম সম্পাদনের মধ্যে দিয়ে আমাদের অভ্যাস গড়ে ওঠে । বার বার একই জিনিস করবার আমাদের একটা স্বাভাবিক বৃত্তি আছে। মানুষ যেটা একবার করে আবার সেটা করবার ইচ্ছে হয়। কেন ওরকম ইচ্ছে করে ? একটু বিচার করে দেখা যাক। মানুষ কাজ করে কি থেকে ? 
মানুষ কাজ করে চিন্তা থেকে। একটা কাজ করবার চিন্তা মানুষের মনে এলে, তখন সে তার দেহ বা অন্যান্য যন্ত্র বা অন্যান্য সামগ্রীর সাহায্যে তার ইচ্ছাটাকে রূপ দেবার চেষ্টা করে। তাকেই কাজ করা বলে। কিন্তু সেই কাজের জনক কে ? কাজের কারনটা কোথায় ? কাজের কারনটা মনে, চিন্তায়। তা হলে যদি আমাদের ভাল চরিত্রের জন্য ভাল কাজ বার বার করতে হয়, তা হলে ভাল চিন্তা মনে আসে সেই চেষ্টা করতে হবে। তা হলে আবার দেখছি, মনের দখল নেবার দিকে আমাদের চেষ্টা রাখতে হবে। এটা অত্যন্ত প্রয়োজন। এখন এই অভ্যাস কি করা যায় ? এটা হয় কিভাবে ?
১৫.
মনের কাজ 
এটা হয় মনের ভেতর, বলছি আমরা। কিন্তু মন জিনিসটা কি ? সেটা সব সময়ই ধোঁয়া ধোঁয়া থেকে যাচ্ছে আমাদের কাছে। একটা মনের স্পষ্ট ছবি আমরা পাচ্ছি না। মনটা এই রকম। মনটা হচ্ছে ক্যামেরা যন্ত্রের মতন। আমরা ক্যামেরায় ছবি তুলি। কি করে তুলছি? 
একটা ছাপ গ্রহনক্ষম ফিল্ম আমার ক্যামেরার মধ্যে ভরা আছে। সেটা এমন ভাবে তৈরী করা, সেটার ওপরে আলো পড়লে একটা রাসায়নিক প্রক্রিয়া হয়। যেখানটা আলো পড়ল না সেখানটা হল না। কাজেই যে বস্তুর সামনে ক্যামেরাটি রেখে আমি শাটারটা টিপলাম, আচ্ছাদনটা সরে গিয়ে একটু আলো সেখান দিয়ে ঢুকলো। যে বস্তুটি রয়েছে তার চারিদিকের রেখা বা যা কিছু রয়েছে সে সমস্ত জায়গা থেকে ঐখান দিয়ে এসে, যেখান থেকে সেটা আসছে ঠিক সেই জায়গাগুলো থেকে আলোগুলো পড়লো। কাজেই যখন আমি সেটা শোধন করলাম, যে বস্তুটার সামনে রেখে ক্যামেরায় আলো ফেলেছিলাম, যে ছবির বিভিন্ন অংশ থেকে বিভিন্ন রকমের আলো কম বেশি পড়েছিল, তার ছবিটা ফিল্মের ওপর ওঠে গেল। 
মানুষের মনটা ঠিক এরকম একটি ক্যামেরা যন্ত্রের মতন। আমরা বাইরের বস্তুজগতের সামনে যখন মনটা নিয়ে দাঁড়াচ্ছি তখন আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো হচ্ছে আমাদের এই দেহ-ক্যামেরা -যন্ত্রের একটি লেন্স। যখন আমরা চোখের পাতটা ফেলি, চোখের পাতটি তুলি, ঠিক ঐ ক্যামেরার শাটারেরই মতন করছি আর একবার একবার চোখ খুলছি আর একটা একটা দৃশ্য আসছে। কিন্তু মন যন্ত্রটি ক্যামেরার থেকে আরও জটিল। এ শুধু চোখ দিয়ে আলো নেয় না, কান দিয়ে ধ্বনি নেয়, নাক দিয়ে ঘ্রান নেয়, ত্বক দিয়ে স্পর্শ নেয়, জিহবা দিয়ে রস নেয়। পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে পাঁচ রকমের ইন্দ্রিয়-উপাত্ত, বাইরের থেকে একই ক্যামেরা যন্ত্রের একটি ত্বকের ওপর নেয়। 
যেমন সবাক চলচিত্রের ফিল্ম দুটোকে কোন রকম জোড়াতালি দেওয়া হয়েছে - একটা আলোকে, আর একটা ধ্বনিকে। আমরা ধ্বনি এবং ছবি, এক সঙ্গে তুলছি। 
কিন্তু আমাদের এই মন-যন্ত্রটি আমরা মানুষের বুদ্ধি দিয়ে তৈরী করিনি। এটি আরও সুন্দর ক্যামেরা। সেটা দিয়ে পাঁচ রকমের ইন্দ্রিয় দিয়ে ধরা যায় পাঁচ রকমের উপাত্ত। আমরা পাঁচ রকমের সংবাদ বাইরে থেকে সংগ্ৰহ করে ঐ মনের একটি প্লেটে সবটা একসঙ্গে ফেলতে পারি এবং সেই মনের প্লেট বা ফিল্মটিকে বিশোধিত করে এই পাঁচ রকম ইন্দ্রিয় উপাত্তের মোট দীর্ঘস্থায়ী ছাপ আমাদের মনের মধ্যে রেখে দিতে পারি। 
একটি ফুলের গন্ধ আমি এখন শুঁকলাম। একটি গোলাপ ফুল। চমৎকার সেই গন্ধের ছাপ আমার মনে এমনভাবে রাখতে পারি যে, পরে যখন একটি গোলাপ দূর থেকে দেখব অথবা গোলাপ ফুলের কথা চিন্তামাত্র করব, তখন পারস্পরিক সম্পর্কের ধর্ম (Law of Association) আমার মনের মধ্যে সেই গোলাপের গন্ধটাও পুনর্জাগরিত হবে! আমি একটা গোলাপের দিকে চেয়ে দেখামাত্র বা গোলাপের কথা ভাবামাত্র মনে মনে গোলাপের বিশেষ সৌরভটা আবার ভোগ করতে পারব। সমস্ত বিষয়ে এই রকম। 
কাজেই এ রকম করতে করতে আমাদের মনের মধ্যে কতকগুলি ছাপ প্রায় চিরস্থায়ী হয়ে যায়, আমরা যখন কাজ করি। এই মনযন্ত্রটা নিয়ে আমরা ঘুরছি। তাতে বাইরের যা কিছু আছে সবের ভাব ক্রমাগত যাচ্ছে। যেমন টেলিপ্রিন্টারে খবরের কাগজের অফিসে বা অন্যত্র ক্রমাগত প্রতি মুহূর্ত সারা বিশ্বের কত সংবাদ এসে ছাপা হয়ে যাচ্ছে পর পর। তার মধ্যে থেকে বেছে কেউ একটা করে শিরোনাম দিয়ে কোন সংবাদ দেবে, কতটা দেবে ঠিক করছে।
তেমন এই মন-ক্যামেরার সামনে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মধ্যে দিয়ে বিশ্বজগতের শত সহস্র সংবাদ (সংবাদ আমার মনে এক রকমের নয়, পাঁচ রকমের) মনের মধ্যে চলে যাচ্ছে। এর মধ্যে আমরা যে কাজগুলো করছি সেগুলোও কতকগুলি জিনিস। আমরা যে চিন্তা করছি সেগুলোও কতকগুলো জিনিস, আমরা যে কথা বলছি সেগুলোও কতকগুলো জিনিস। আমরা যে চিন্তা করছি, কথা বলছি, কাজ করছি, সেগুলোও কিন্তু তখন এই ক্যামেরায় নেওয়া ছবি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সেই চিন্তাগুলো, সেই কাজগুলো সেই কথাগুলো সমান পদ্ধতির প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আমাদের মনে ছবি ফেলছে, ছাপ রাখছে। 
আমি যে কাজ নিজে করছি সেই কাজের ছবি অন্যে যে কাজ করছে তার থেকে তার থেকে আর একটু বেশি দাগ কাটতে পারে। কারণ সেখানে আমার অহংকার-বুদ্ধি রয়েছে, থাকতে বাধ্য। যে কাজটার কর্তা অন্যে, তা থেকে যে কাজটার কর্তা আমি নিজে সেটার প্রাধান্য আমি দেবই, আপনিই দেব, না ভাবলেও দেব, কারন এটা আমার ! স্বাভাবিকভাবে সকলেই 'আমি-আমার' টা বেশি ভালবাসি। আমি করেছি এই ভাবটা আমাদের মধ্যে আছে। আমাদের অহংকার আছে। আমরা যে করছি, এ বোধটা না ভাবলেও আছে। কাজেই আমার কাজের, আমার চিন্তার, আমার কথার ছাপ আমার মনে যেটা পড়বে, সেটা অন্যের চিন্তা, অন্যের কথা, অন্যের কাজের থেকে বেশি দাগ কাটবে, বেশি স্পষ্ট ছাপ রাখবে। 
আমি যে চিন্তা একবার করলাম সেটা যদি বার বার করি, তা হলে আমার মনের মধ্যে সেই রকম চিন্তার একটা গভীর খাত হয়ে যাবে। যেমন ভাবে গ্রামে ধান কাটা হয়ে যাবার পরে, যেখানে খুব ভাল রাস্তা-ঘাট নেই, সেখানে যখন মাঠের মধ্যে দিয়ে গরুর গাড়ি যায়, গরুর গাড়ি যেতে যেতে, যাকে লিক বলে, দুটো চাকার দাগ পড়ে যায়, পরের গরুর গাড়ি যখন আসে তখন গরুর গাড়ির চালককে আর সেখান দিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে ছিপটি মারতে হয় না, দড়িটি টানতে হয় না। গরু আপনা থেকেই সেই লিক ধরে এঁকে বেঁকে যায়। 
আমাদের মনের চিন্তা, কথা এবং কাজ আমাদের আগেকার সেই চিন্তা, কথা এবং কাজের যে দাগগুলো পড়ে আছে মনে, সেগুলোকে অনুসরণ করে যেতে চায়, ঐ নির্বোধ গরুর মতন, স্বাভাবিক ভাবে, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে। এভাবেই আমাদের অভ্যাস গড়ে ওঠে। 
১৬.
চরিত্রের সংজ্ঞা ও ভবিতব্য 
সেজন্যে আমরা বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করে দেখতে পাই, যে কাজ আমরা করি, সে কাজ আবার করবার প্রবৃত্তি কেন আসে ? এবং সেটা যদি বার বার করে যাই তা হলে এই যে দাগ মনের মধ্যে আমার চিন্তার, আমার কথার আমার কাজের সেটা কেন গভীর হয়ে যাবে? সেটিকেই আমরা বলি অভ্যাস। সেটা গভীরতর হলে তা হয় আমাদের 'প্রবণতা' এবং সেই রকম নানান রকমের প্রবণতার সমাহারই হল আমাদের চরিত্র। 
তা হলে আমরা এই বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে দেখতে পাই যে, আমাদের চরিত্র আমরা ইচ্ছানুরূপ করতে পারি। আমাদের চরিত্র আমাদের জন্মগত নয়। আমাদের চরিত্র বিধাতা আমাদের কপালে লিখে দেন না, আমরাই আমাদের ভবিতব্যের স্রষ্টা। কারন, আমাদের চরিত্রই আমাদের ভবিতব্যকে গড়ে তুলবে। 
চিন্তা আমাদের কাজে প্রবৃত্ত করবে, আমাদের কর্ম আমাদের অভ্যাসে পরিণত হবে। অভ্যাস পরিপক্ব হয়ে আমাদের প্রবণতা আসবে। প্রবণতার সমাহার হবে আমাদের চরিত্র। চরিত্রের অনুবর্তী হয়ে ক্রমাগত আমরা সারাজীবন কাজ করতে করতে আমাদের ভাগ্য, ভবিষ্যৎ নিজেরাই গড়ে তুলব। 
কাজেই ইটা যখন জানলাম তখন আমার দায়িত্ব খুব বেড়ে গেল। কারন আমার ভবিষ্যতের জন্যে আমি ছাড়া আর কেউ দায়ী নয়। কাজেই অল্প বয়স থেকে আমার চিন্তা, আমার ব্যবহার, আমার বাক্য, আমার কর্ম কে সংযত, শাসিত, চালিত করব। সাবধান হব, চিন্তা করে সেগুলোকে ভাল দিকে নিয়ে গিয়ে একটা ভাল চরিত্র গড়ে তুলব। কারন যদি তা না করি আমার ভবিষ্যৎ খারাপ হবে। 
যেমন আমার চরিত্র, আমার ভবিষ্যৎ, সেই রকম প্রত্যেক 'আমি' সমাজে রয়েছে, যাদের নিয়ে সমস্ত সমাজ। তা হলে সমাজের ভবিষ্যৎ এই ব্যাক্তিগুলোর ভবিষ্যতের ওপর নির্ভর করছে। সমাজের ভাল যদি করতে হয় তা হলে প্রত্যেকটি ব্যক্তির ভবিষ্যৎ ভাল করবার জন্য প্রয়োজনীয় চরিত্র প্রত্যেকের গড়ে তুলতে হবে। সেই জন্যে সামাজিক বিপ্লব যদি সত্যি আনতে হয়, সমস্ত সমাজের আমূল পরিবর্তন, যেটা স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন - সেই পরিবর্তনের নামই বিপ্লব - সেই আমূল পরিবর্তন যদি সমাজে আনতে হয় তা হলে প্রত্যেকটি ব্যক্তির চরিত্র সম্বন্ধে সচেতন, সাবধান হতে হবে এবং প্রযত্ন নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে চালিয়ে যেতে হবে, অক্লান্তভাবে ক্রমাগত চালিয়ে যেতে হবে। সংকল্পে স্থির থাকতে হবে। যুক্তিতে প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে যে , এ ছাড়া উপায় নেই।এখন অন্তত এটুকু আমরা বুঝতে পেরেছি যে, চরিত্র কাকে বলে, চরিত্র কিভাবে তৈরী করা যেতে পারে, চরিত্রের দোষত্রূটি কি ভাবে কমানো যেতে পারে এবং আমাদের চরিত্র তৈরী করার ওপরে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের ভবিষ্যৎ কতখানি নির্ভর করছে এবং কেমন ভাবে আমাদের প্রত্যেকের ভবিষ্যৎ এবং চরিত্রের ওপর আমাদের সমাজের চরিত্র এবং ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। যদি সমাজ ও জাতির প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র কর্তব্যবোধ থেকে থাকে, তা হলে আমরা চরিত্র গঠনের জন্য প্রযত্ন করব এবং তার উপায় আরও ভাল করে জেনে নেবার চেষ্টা করব। এই শিক্ষাই যথার্থ শিক্ষা যা সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম । 
------------------------------------------
প্রথম প্রকাশ -ডিসেম্বর, ১৯৮৭ 
====================                               
     
       




    

  










कोई टिप्पणी नहीं:

एक टिप्पणी भेजें